পৃথিবীর সবচেয়ে পরিচিত ব্র্যান্ডের নাম নিতে গেলেবেনসন অ্যান্ড হেজেস এর নাম সামনের দিকেই থাকবে। ধূমপায়ীরা তো বটেই এমনকি অধূমপায়ীদের লোকজনও এই ব্র্যান্ডকে এক নামে চেনে। বাংলাদেশেও প্রচন্ড জনপ্রিয় বেনসন অ্যান্ড হেজেস। আজকে আমরা জানবো এই ব্র্যান্ডটি সম্পর্কে।
প্রতিষ্ঠা এবং প্রাথমিক বিকাশ
উইলিয়াম হেজেস (১৮৩৬-১৯১৩)এবং রিচার্ড ম্যাথিয়াস বেনসন (১৮১৭-১৮৮২)১৮৭৩ সালে লন্ডনের ১৩ ওল্ড বন্ড স্ট্রীটে নিজেদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানবেনসন অ্যান্ড হেজেস লিমিটেডএর সূত্রপাত করেন। তামাক ব্যবসায়ী হিসেবে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করার পাশাপাশি এসময় তারা সিগারও আমদানি করতেন। তাদের সিগার ব্রান্ডের নাম ছিলো হ্যামলেট সিগার্স। সাধারণ একটি রাস্তাতে বসেই তারা অভিজাত বাজার ধরার পরিকল্পনা করেন। মূলত প্রিন্স অফ ওয়েলস, অ্যালবার্ট অ্যাডওয়ার্ডের জন্য সিগারেটের যোগান দিতেই বেনসন অ্যান্ড হেজেস গঠিত হয়।
অনেকদিন তাদের সিগারেট উৎপাদন কারখানা ছিলো উত্তর আয়ারল্যান্ডের ব্যালিমেনায়৷ পরে ২০১৭ সালে কারখানা পূর্ব ইউরোপে সরিয়ে নেয়া হয়।
উইলিয়াম হেজেসের জন্ম হয় সেইন্ট মারলিবানে। তার পিতা ছিলেন একজন কয়লা ব্যবসায়ী এবং অত্যন্ত ধার্মিক ব্যক্তি৷ ছেলের তামাক ব্যবসাকে তিনি ভালো চোখে দেখতেন না।
রিচার্ড বেনসনের ব্রিস্টলে তামাকের ব্যবসা ছিলো, বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে এই ব্যবসায় আগমন ঘটে তার। তিনি ছিলেন অত্যন্ত কর্কশ প্রকৃতির মানুষ। হেজেসের সাথে মিলের চেয়ে অমিলই বেশি ছিলো তার। ওনার বেশিরভাগ সময়ই কাটতো ব্রিস্টলে নিজের প্রতিষ্ঠানে। তবে লন্ডনে অবস্থানকালে তাকে আলুথালু পোশাক পরা অবস্থায় বেনসন অ্যান্ড হেজেস দোকানের সামনে দেখা যেত। এসময় তিনি একের পর এক সিগার ফুঁকতেন এবং কোন বিবেচনা ছাড়াই রাস্তায় থুথু ফেলতেন৷
বেনসনের দিনে ১৪-১৫টি সিগারেট লাগতো। তিনি মারা যান ১৮৮২ সালে। ধারণা করা হয় অতিরিক্ত ধূমপানের কারণেই তার মৃত্যু হয়। তার জীবদ্দশায় তিনি নিজের কোম্পানির স্টক থেকে আনুমানিক ২০,০০০ পাউন্ড মূল্যমানের সিগারেট ব্যবহার করেছিলেন।
ব্রিটিশ রাজপরিবারকে ৫ বছর প্রয়োজনীয় সিগারেট সাপ্লাই দেওয়ার পর ১৮৭৮ সালে প্রথমবারের মত রাজকীয় সনদ লাভ করে বেনসন অ্যান্ড হেজেস। তার ৫ বছর পর অর্থাৎ, ১৮৮৩ সালে এই কোম্পানি কায়রো সিটাডেলনামক সিগারেটের ট্রেডমার্কের জন্য আবেদন করে। এই ধরণের সিগারেট তারা বানায় প্রিন্স অফ ওয়েলস এর জন্য। কারণ তিনি মিশর সফর করার সময় সেখান থেকে ঐদেশের তামাক সঙ্গে করে নিয়ে আসেন।
নিজের ধূমপানের জন্য বহুল আলোচিত ব্রিটিশরাজা ৬ষ্ট জর্জএর প্রিয় সিগারেট ব্র্যান্ড ছিলো বেনসন অ্যান্ড হেজেস।
কোম্পানিতে এ পি হেজেসের আগমন
রিচার্ড বেনসনের মৃত্যুর পর উইলিয়াম হেজেসের ছেলে অ্যালফ্রেড প্যাজেট হেজেস (১৮৬৭-১৯২৯) পিতার সহকারী হিসেবে কোম্পানিতে যোগ দেন ১৮৮৫ সালে। তিনি ছিলেন প্রচন্ড আকাঙ্ক্ষী একজন আপাদমস্তক ভদ্রলোক। কোম্পানির উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন তিনি। ১৮৯৬ সালে বেনসন অ্যান্ড হেজেস একটি প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানিতে রুপান্তরিত হয়।
উত্তর আমেরিকায় ব্যবসার সম্প্রসারণ
লন্ডনে বেনসন অ্যান্ড হেজেসের ব্যবসার পসার দেখে অনেক ধনী আমেরিকান আকৃষ্ট হন। ফলে উইলিয়াম হেজেস ১৮৯৭ সালে আমেরিকায় ব্যবসার সম্প্রসারণ করেন। তাদের আওতাধীন কোম্পানির অফিসটির অবস্থান ছিলো নিউ ইয়র্কের ২৮৮ ফিফথ অ্যাভিনিউতে। এই অফিসের দায়িত্ব নিতে পাঠানো হয় আর্থার কুইন্টন ওয়ালশকে। তিনি দীর্ঘদিন কোম্পানিতে হিসাবরক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন। তুলনামূলকভাবে আমেরিকায় ব্যবসার কলেবর ছিলো ছোট৷ এখানে উন্নত মানের সিগার এবং প্রিমিয়াম মানের সিগারেট বিক্রি ও তৈরী করা হতো।
নিউ ইয়র্ক শাখার অফিসে ব্যবসার তেমন উন্নতি হচ্ছিলো না। অফিসের অবস্থান ২য় তলায় হওয়ায়, তারা পথচারীদেরকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হচ্ছিলেন না। ফলে ওয়ালশ ব্যবসার উন্নতির জন্য সমৃদ্ধ এলাকা রোড আইল্যান্ডের নিউপোর্টে অপর একটি আউটলেট খোলেন।
কোম্পানির আদেশ অমান্য করে ওয়ালশ ১৯০০ সালে নিউ ইয়র্কের আউটলেটের স্থান পরিবর্তন করে ৩১৪ ফিফথ অ্যাভিনিউতে নিয়ে আসেন। এরপর ১৯০৫ সালে আবার এটিকে ১৭ ওয়েস্ট থার্টি ফার্স্ট স্ট্রীটে স্থানান্তরিত করেন। কিন্তু এখানেও জায়গাটি ব্যবসার জন্য উপযুক্ত না হওয়ায় ব্যবসা ভালো যাচ্ছিলো না। ফলে ১৯০৭ সালে আবারও এটি স্থানান্তরিত হয়ে ৪১৫ ফিফথ অ্যাভিনিউতে আসে।
১৯০৬ সালে মন্ট্রিয়ালের কোটে স্ট্রীটে কোম্পানির কানাডিয়ান শাখা খোলা হয়। বেনসন অ্যান্ড হেজেসের মতে উত্তর আমেরিকায় তাদের উভয় শাখাই ছিলো সফল।
১৯০১ সালের দিকে পিতার অবসরের পর এ পি হেজেস কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর হন। পিতা এবং দাদার মত তিনিও ছিলেন ওয়েজলিয়ান মেথডিস্ট এবং সময়ে সময়ে ধর্ম প্রচারের কাজও করতেন। ১৯০৬-১৯১০ সাল পর্যন্ত তিনি কেন্টের টানব্রিজের সংসদ সদস্যের দায়িত্ব পালন করেন। রাজনৈতিক দল লিবারেল পার্টির সদস্য ছিলেন তিনি।
১৯০৬ সাল নাগাদ বেনসন অ্যান্ড হেজেস রাজা ৭ম অ্যাডওয়ার্ডএর জন্য সিগারেট সাপ্লাই করার দায়িত্ব পায় এবং রাজকীয় সনদ অর্জন করে। ১৯১০ সালে কোম্পানিকে পাবলিক কোম্পানিতে রুপান্তরিত করা হয়। তখন তাদের মূলধন ছিলো ১,২০,০০০ পাউন্ড। নিজেদেরকে পাবলিক কোম্পানিতে পরিণত করার কারণ ছিলো অর্থের সংস্থান করা। লন্ডন এবং মন্ট্রিয়ালে ব্যবসার সম্প্রসারণের কারণে তাদের কোম্পানি চালাতে আরো বেশি অর্থের প্রয়োজন ছিলো। ১৯১৭ সাল নাগাদ তারা পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি সিগারেট বিক্রি করা কোম্পানিগুলোর একটিতে পরিণত হয়।
১৯২০ সালে কোম্পানির মূলধনের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়। টাকার অংকে যেটির পরিমাণ ছিলো ২,২০,০০০ পাউন্ড। এসময় তারা ফুলহ্যামের ১০৪, নিউ কিং’স রোডে নতুন একটি সিগারেট ফ্যাক্টরি খোলে। এছাড়া উত্তর আমেরিকান শাখাগুলোর জন্য অধিক মূলধনের যোগান দেওয়াও তাদের উদ্দেশ্য ছিলো।
লন্ডন এবং আমেরিকান উভয় শাখাই ক্রমাগত উন্নতি করতে থাকে৷ যার ফলশ্রুতিতে আমেরিকায় ১৯২৩ সালে পাম বীচে ফ্লোরিডা শাখা খোলা হয়।
তবে অর্থনৈতিক মন্দার কারণে এযাবৎকাল পর্যন্ত সফল মন্ট্রিয়াল শাখা কিছুটা লোকসানের মুখে পড়ে ১৯২৫ এবং ১৯২৬ সালে। অর্থনৈতিক মন্দা বেনসন অ্যান্ড হেজেসের বিলাসী সিগারেট বিক্রিকে খুব প্রভাবিত করে। এক্ষেত্রে উচ্চ করহার মূল ভূমিকা পালন করে। কোম্পানি অনুমান করে ব্যবসায় টিকে থাকতে হলে কানাডিয়ান শাখাকে বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হবে। কিন্তু এজন্য প্রয়োজনীয় অর্থ তাদের ছিলো না। যার ফলে ১৯২৬ সালে তারা তাদের কানাডিয়ান শাখা অ্যাডহেমার গ্যাস্টন মিউনিখএর কাছে বিক্রি করে দেয়। তিনি ছিলেন একজন ফরাসী বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান বিনিয়োগকারী।
১৯২৮ সালে কোম্পানির আমেরিকান শাখাও বিক্রি করে দেওয়া হয় দুটি ব্যাংকিং হাউজের কাছে।
বিক্রির পর মাত্র ২০ জনের মত কর্মী নিয়ে তরতর করে এগিয়ে যেতে থাকে এই শাখা। তারাপার্লামেন্টনামে এক ধরণের সিগারেট বাজারজাত করা শুরু করে ১৯৩১ সাল থেকে। ভার্জিনিয়া, তুর্কি এবং বার্লি তামাক থেকে তৈরীকৃত এই প্রিমিয়াম-ফিল্টার্ড সিগারেট পাওয়া যেত তিনটি ফ্লেভারে। এগুলো হলো : যষ্টিমধু, আপেল এবং ব্রাউন শ্যুগার।
১৯৪১ সালে জোসেফ এফ কালম্যানবেনসন অ্যান্ড হেজেস (ইউএসএ)এর ৫৫ শতাংশ শেয়ার কিনে নেন ১ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে।
১৯২৯ সালে লন্ডনে নিজের অফিসে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান এ পি হেজেস। মেজর আর্থার পিয়ারসন ডেভিসন (১৮৬৬-১৯৫৫) কোম্পানির নতুন ম্যানেজিং ডিরেক্টর নির্বাচিত হন।
১৯৩০ সালের দিকে খোলা হয় কোম্পানির আরেকটি শাখা। এটির নাম দেওয়া হয় বেনসন অ্যান্ড হেজেস (ওভারসিজ) লিমিটেড।এটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আব্রাহাম উইক্স।কোম্পানির এই শাখা উত্তর আমেরিকা ব্যতীত পৃথিবীর অন্যান্য অংশে তাদের ব্র্যান্ডের সিগারেটের বিপণনের ব্যাপারটি দেখতো।
ইংল্যান্ডে কিন্তু সমানতালেই এগিয়ে যাচ্ছিলো বেনসন অ্যান্ড হেজেস লিমিটেড। ১৯৪৬ সালে তারারাজা ৬ষ্ঠ জর্জকে সিগারেট সাপ্লাই করার জন্য আবারও রাজকীয় সনদ লাভ করে।
ফিলিপ মরিস এবং গ্যালাহার এর আগমন
১৯৫২ সাল নাগাদ বেনসন অ্যান্ড হেজেস (ইউএসএ) সেই দেশের ৭ম সর্ববৃহৎ সিগারেট উৎপাদনকারী কোম্পানিতে পরিণত হয়। তাদের বিক্রিত সিগারেটের সিংহভাগই ছিলো পার্লামেন্ট ব্র্যান্ড। কিন্তু এত বড় এবং ক্রমশ আরো বর্ধমান কোম্পানির জন্য যে পরিমাণের রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট এবং মার্কেটিং এর প্রয়োজন হয়, ততটুকু তৎকালীন মালিকরা করতে পারছিলো না। ফলে ১৯৫৩ সালে বেনসন অ্যান্ড হেজেসকে (ইউএসএ) কে বিক্রি করে দেওয়া হয় ফিলিপ মরিসনামক কোম্পানির কাছে। এই কোম্পানি এমনিতে সেই দেশের ৪র্থ সর্ববৃহৎ সিগারেট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ছিলো কিন্তু তাদের কোন সফল ফিল্টার্ড সিগারেটের ব্র্যান্ড ছিলো না। কোম্পানির মালিকানা পরিবর্তনের পর ১৯৫৩ সাল থেকে ১৯৬১ সালের মধ্যে উন্নত বিতরণ ব্যবস্থা এবং ক্রমবর্ধমান চাহিদার কারণে পার্লামেন্ট ব্র্যান্ডের সিগারেটের বিক্রি ৩ গুণ বেড়ে যায়।
ওল্ড বন্ড স্ট্রীটের বেনসন অ্যান্ড হেজেস আগের মতই চলছিলো। তাদের লাক্সারি সিগারেট তৈরীর দক্ষতা এক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করছিলো। ১৯৫৫ সালে এই মূল কোম্পানি বিক্রি হয়ে যায় গ্যালাহার্সনামক অপর একটি বৃহৎ ব্রিটিশ তামাক কোম্পানির কাছে।
বেনসন অ্যান্ড হেজেস (ওভারসিজ) শাখার বিক্রি এবং ফিলিপ মরিসের কানাডা শাখা ক্রয়
১৯৫৬ সালেও ব্রিটিশ রাজপরিবারের ধূমপানের চাহিদা মেটানোর দায়িত্ব এবং রাজকীয় সনদ পায় বেনসন অ্যান্ড হেজেস। এসময় সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন রাণী ২য় এলিজাবেথ।
একই বছরে সালে আব্রাহাম উইক্স কর্তৃক স্থাপিতবেনসন অ্যান্ড হেজেস (ওভারসিজ)শাখাব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কিনে নেয়।
অন্যদিকে, ১৯৫৮ সালে ফিলিপ মরিস বেনসন অ্যান্ড হেজেস এর স্বাধীন কানাডিয়ান শাখাকে কিনে নেয় পঞ্চাশ লক্ষ ডলারের বিনিময়ে। এই শাখা সিগার উৎপাদনের ব্যাপারে বেশী মনোযোগী ছিলো।
এছাড়া ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোনানা রদবদল এবং বাংলাদেশ সহ কোম্পানির বিশ্বব্যাপী কিভাবে ছড়িয়ে পড়লে তা জানতে পড়ুন পরবর্তী অংশ (২য় পর্ব)।
This is a Bangla article. This article is about the history of the famous cigarette brand Benson & Hedges.
All the necessary links are hyperlinked.
Featured images are collected from Google.