ব্যয়বহুল, পুনরায় ব্যবহার করা সম্ভব নয় এমন রকেটগুলো এখন ইতিহাস৷ ধরিত্রীকে রক্ষার জন্য এখানকার ভারী ইন্ডাস্ট্রিগুলোকে মহাশূন্যে নিয়ে যাওয়ার মাঝেই মানবজাতির কল্যাণ নিহিত। পাশাপাশি কম খরচে এবং নিরাপদে মহাশূন্যে ভ্রমণের ব্যাপারটি নিশ্চিত করার লক্ষ্যেও কাজ করে যাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা এবং এই সেক্টরে উৎসাহী উদ্যোক্তারা।
ব্লু অরিজিননামক কোম্পানিটি কাজ করছে এসব লক্ষ্য অর্জনের পথে মানবজাতিকে সাহায্য করতে।
আগে ব্লু অরিজিন ছিলো একটি সিক্রেটিভ রিসার্চ কোম্পানি। বর্তমানে তাদের কাছে আছে পরীক্ষিত রকেট লঞ্চ সিস্টেম এবং অ্যাডভান্সড প্ল্যান; যেগুলোর মাধ্যমে তারা টাকার বিনিময়ে ভারী ইন্ডাস্ট্রির যন্ত্রপাতি এবং মহাকাশ ভ্রমণে আগ্রহী পর্যটকদের মহাশূন্যে নিয়ে যেতে চায়।
ক্রমশ বর্ধমান এই কোম্পানি অর্জন করছে কমার্শিয়াল কন্ট্র্যাক্ট। মহাশূন্য ভ্রমণের ক্ষেত্রে তারা অ্যামাজনএর মত সফল হতে পারবে কিনা সে প্রশ্নের উত্তর তোলা রইলো সময়ের হাতে। তবে এখন পর্যন্ত তারা রয়েছে সঠিক পথে।
আজকে এই কোম্পানি সম্পর্কে বিশদভাবে জানতে চেষ্টা করবো আমরা।
ব্লু অরিজিন কি এবং এটির মালিক কে?
ব্লু অরিজিনহলো ২০০০ সালের ৮ই সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠিত একটি মহাকাশ যান নির্মাণকারী কোম্পানি। এটির সিইও’র দায়িত্বে আছেন বব স্মিথএবং ২০১৯ সালের তথ্যানুযায়ী কোম্পানিতে মোট কর্মরত লোকের সংখ্যা ২৫০০। এখন পর্যন্ত কোম্পানির পুরো অর্থায়ন এসেছে বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি জেফ বেজোসেরপকেট থেকে। এই কোম্পানিটির মালিকানা ছাড়াও জেফ বেজোস অ্যামাজনএর সিইও এবং দ্যা ওয়াশিংটন পোস্টপত্রিকার মালিক। এখন পর্যন্ত ব্লু অরিজিনের যে সমস্ত অর্জন, তার সবকিছুর পেছনে মূল চালিকাশক্তি হলেন জেফ। নিউ ইয়র্ক টাইমসএর সূত্রমতে বেজোস প্রতিবছর নিজের ১ বিলিয়ন ডলার মূল্যের অ্যামাজন স্টক বিক্রি করে এর খরচ যোগান।
২০১৯ সালে জেফ বেজোসের সাথে তার স্ত্রীম্যাকেঞ্জিএর ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় কিন্তু ম্যাকেঞ্জি তাকে ওয়াশিংটন পোস্ট এবং ব্লু অরিজিন এর তার মালিকানায় থাকা সমস্ত শেয়ার দিয়ে দিয়েছেন৷ তাই মালিকানা নিয়ে কোন জটিলতা নেই।
এছাড়া বর্তমানে খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে ব্লু অরিজিন বেশকিছু কমার্শিয়াল চুক্তি সাক্ষর করেছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে। ফলে তারা এখন ক্রমশ নিজেদের কলেবর বাড়াচ্ছে এবং ভবিষ্যতে তাদেরকে কেবল বেজোসের ব্যক্তিগত অর্থায়নের উপর নির্ভর করে থাকতে হবে না।
যেভাবে ব্লু অরিজিনের ভাবনা মাথায় আসে বেজোসের
ছোটবেলা থেকেই মহাকাশের ব্যাপারে আগ্রহ ছিলো জেফ বেজোসের। ১৯৮২ সালে নিজের হাই স্কুল ক্লাসের বিদায়ী বক্তৃতা দেওয়ার দায়িত্ব পাওয়ার পর ১৮ বছর বয়সী বেজোস মায়ামি হেরাল্ডপত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, তিনি পৃথিবীকে রক্ষা করতে চান; মহাশূন্যে হোটেল, অ্যামিউজমেন্ট পার্ক এবং ২ বা ৩ মিলিয়ন লোকের জন্য কলোনি নির্মাণ করতে চান৷ মূলত তার যে ইচ্ছা সেটি হলো তিনি মানুষকে মহাশূন্যে নিয়ে যাবেন এবং সেখান থেকে ইচ্ছা করলে তারা পৃথিবীতে ঘুরতে আসতে পারবে।
১৯৯৯ সালে রকেট বিষয়ক সিনেমা অক্টোবর স্কাইদেখে সায়েন্স ফিকশন লেখক নীল স্টেফেনসনের সাথে এই বিষয়ক একটি কোম্পানি খোলার ব্যাপারে কথা বলেন।
মূলত তরুণ বয়সের আগ্রহ এবং পরিণত বয়সের ভাবনা থেকেই তিনি ব্লু অরিজিনের মত মহাশূন্য বিষয়ক কোম্পানির প্রতিষ্ঠা করেন।
অবস্থান
ওয়াশিংটনের কেন্টএ ব্লু অরিজিনের নতুন হেডকোয়ার্টার এবং রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফ্যাসিলিটি খোলা হয়েছে। যদিও এটির বিজ্ঞানীরা ওয়েস্ট টেক্সাসের ভ্যান হর্নে বেজোসের র্যাঞ্চে অবস্থিত একটি প্রাইভেট সাবঅরবিটাল লঞ্চ এবং ইঞ্জিন টেস্ট সাইট থেকে তাদের রকেটগুলোর তদারকি করেন। বর্তমানে তারা ফ্লোরিডার কেপ ক্যানাভেরাল এয়ার ফোর্স স্টেশনে একটি অরবিটাল লঞ্চ ফ্যাসিলিটি তৈরী করছে। এর কাছেই তৈরী হবে একটি রকেট কনস্ট্রাকশন ফ্যাসিলিটি। এছাড়া অ্যালাবামার হান্টসভিলে তারা ২০০ বিলিয়ন ডলারের একটি রকেট এঞ্জিন প্রোডাকশন ফ্যাসিলিটি বানাচ্ছে।
২০১৯ সালের এপ্রিলে ব্লু অরিজিন নাসার সাথে একটি চুক্তি সাক্ষর করে। এই চুক্তির ফলে তারা হান্টসভিলে অবস্থিত নাসার মার্শাল স্পেস ফ্লাইট সেন্টারে নিজেদের উদ্ভাবিত বিই-থ্রিইউ এবং বিই-ফোর রকেট এঞ্জিন পরীক্ষার সুযোগ পাবে। দুটি এঞ্জিনেরই জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয় তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস। এই ৩০০ ফুট লম্বা ভার্টিক্যাল ফায়ারিং টেস্ট স্ট্যান্ড ৪৬৭০ ষাটের দশকে ব্যবহৃত হয়েছিলো বিশাল আকৃতির স্যাটার্ন ফাইভ রকেটের টেস্টিংয়ে, যেগুলো মহাকাশযান অ্যাপোলোকে চাঁদে নিয়ে গিয়েছিল। এছাড়া স্পেস শাটলের এঞ্জিনের টেস্টিংও এখানে সম্পন্ন হয়েছিলো।
ইউএস এয়ার ফোর্স তাদের ভবিষ্যতের সুপার রকেট নিউ গ্লেনব্যবহারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তাই ব্লু অরিজিন ক্যালিফোর্নিয়ার ভ্যান্ডারবার্গ এয়ার ফোর্স বেইসে একটি লঞ্চ সাইট তৈরীর কথা ভাবছে।
দিনদিন বড় হচ্ছে ব্লু অরিজিন। তবে স্পেসএক্সের অবস্থানে পৌঁছাতে তাদেরকে পাড়ি দিতে হবে আরো বেশকিছুটা পথ।
লোগো এবং মটো
নিজেদের লোগো হিসেবে ব্লু অরিজিন বেছে নিয়েছে ভাসমান পাখির পালককে। তাদের মতে পাখির পালকই হলো পার্ফেক্ট ফ্লাইটের প্রতীক। এছাড়াও এটি স্বাধীনতা, অনুসন্ধিৎসা, গতিময়তাএবং অগ্রগতিরপ্রতীক। হাজার বছর ধরে উড্ডয়নশীল পাখিদের দিকে তাকিয়ে আমরা ভেবেছি উড়তে কেমন লাগে! আর এখন আমরা অন্য নক্ষত্রে নিজেদের উজ্জ্বল ভবিষ্যত তৈরীর ব্যাপারে ব্রতী হয়েছি। ব্লু অরিজিন মানুষকে পৌঁছে দিতে চায় গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে।
কোম্পানির মটো বা স্লোগান হলো গ্রাডাটিম ফেরোসিটার।এই ল্যাটিন বাক্যের অর্থ হলো “ধীরে ধীরে, ক্ষিপ্রতার সাথে।”
এটি কোম্পানির হার না মানা মানসিকতার পরিচায়ক। এছাড়া এই বাক্য তাদের দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনার দিকেও নির্দেশ করে।
ব্লু অরিজিনের দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা
ব্লু অরিজিনের মূল লক্ষ্য হলো এমন প্রযুক্তির আবিষ্কার করা যার মাধ্যমে খুব কম খরচে এবং নির্ভরযোগ্যতার সাথে মানুষ মহাশূন্যে ভ্রমণ করতে সক্ষম হবে। যদিও মানুষ পৃথিবীকে বর্জন করে চিরকালের জন্য এই গ্রহ ছেড়ে অন্য গ্রহে চলে যাক এটি চান না বেজোস। বরং তিনি চান মহাশূন্যে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হোক, ভারী এবং শক্তি উৎপাদনের কাজে ব্যবহৃত শিল্পগুলো এখান থেকে স্থানান্তরিত হোক, যেন পৃথিবীকে রক্ষা করা সম্ভব হয়।
২০১৭ সালে তিনি বলেন, আমরা গ্রহাণু এবং পৃথিবীর কাছাকাছি থাকা বিভিন্ন বস্তু থেকে ও আরো বৃহত্তর ক্ষেত্র থেকে সৌরশক্তি আহরণ করতে পারি এবং চমৎকার সব প্রযুক্তি উদ্ভাবনের কাজ চালিয়ে যেতে পারি। যদি তা করা না হয়, তাহলে পৃথিবী হয়ে যাবে স্থবির এবং নির্জীব, আমরা বাধ্য হবো জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে। এছাড়া শক্তির ব্যবহারও মাথাপিছু হিসেবে ভাগ করে দিতে হবে।
তিনি আরো বলেন, “আমার মনে হয় না স্থবিরতা ও মুক্তি-স্বাধীনতা এই বিষয়গুলো একসাথে যায়। এমন অবস্থা হলে পৃথিবীতে খুবই নিরানন্দ পরিবেশ বিরাজ করবে। আর আমি চাই আমার নাতি-নাতনীদের নাতি-নাতনীরা এমন একটি পৃথিবীর অংশ হোক যেটি অগ্রগামী, অনুসন্ধিৎসু এবং পুরো সৌরজগতজুড়ে বিস্তৃত।”
চন্দ্রাভিযানের ব্যাপারেও ব্লু অরিজিনের আগ্রহ রয়েছে। তারা মুন রেসনামক প্রজেক্টের সাথে যুক্ত। এই প্রজেক্ট চাঁদে আরো বেশি অনুসন্ধান চালানোর ব্যাপারে লোকজনকে আরো আগ্রহী করে তোলার চেষ্টা করছে।
২০১৯ সালের মে মাসে ব্লু অরিজিন তাদের ব্লু মুননামক চাঁদে অবতরণ করতে সক্ষম মহাকাশ যানের প্রদর্শনী করে। এটির দুটি ভ্যারিয়েশন পাওয়া যাবে। একটি ৩.৬ মেট্রিক টন এবং ৬.৫ মেট্রিক টন বোঝা বহন করতে সক্ষম। পরের ভ্যারিয়েশনটি মনুষ্য বহন করতে পারবে।
ব্লু মুন মহাকাশ যানকে উৎক্ষেপণের ক্ষেত্রে ব্লু অরিজিন ব্যবহার করবে তাদের নিউ গ্লেনরকেটকে। এর অবতরণের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত ইঞ্জিনে জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করা হবে লিকুইড নাইট্রোজেন৷ এই লিকুইড নাইট্রোজেন সংস্থান করার ব্যাপারে ব্লু অরিজিন কর্তৃপক্ষ ব্যবহার করতে চায় চাঁদের পোলার আইসকে। ইলেক্ট্রোলাইসিস প্রক্রিয়া ব্যবহারের মাধ্যমে চাঁদের পোলার আইস থেকে লিকুইড নাইট্রোজেন উৎপাদন করতে পারবে বলে আশাবাদী তারা।
আরো পড়ুনঃ
ব্লু অরিজিন : জেফ বেজোসের স্পেস ফ্লাইট কোম্পানি [পর্ব – ২]
এখানেই শেষ হলো ব্লু অরিজিন নিয়ে লেখার ১ম পর্ব। পরের পর্বে আমরা তাদের বিভিন্ন রকেট, কমার্শিয়াল কন্ট্র্যাক্ট, অরবিটাল-সাব অরবিটাল সিস্টেম সম্পর্কে জানবো।
This is a Bangla article. This article covers everything you need to know about Jeff Bezos’s spaceflight company Blue Origin.
All the necessary links are hyperlinked.
Featured images are collected from Google.