লিখুন
ফলো

মঙ্গল গ্রহ এবং আরব আমিরাতের শহর নির্মাণের পরিকল্পনা

সৌরজগতের আটটি গ্রহের মধ্যে যেটা নিয়ে মানুষের কৌতুহলের কখনাে কমতি ছিল না, সেটা নিঃসন্দেহে মঙ্গল গ্রহ। সূর্যের চারপাশে চতুর্থ কক্ষপথে ঘূর্ণায়মান এই গ্রহটিকে ঘিরে মানুষের জল্পনা কল্পনার বীজ বপিত হয়েছে বহু বছর আগেই। গত শতাব্দীর ষাটের দশকে সােভিয়েত ইউনিয়নের ‘Mars 1M’ নামের মহাকাশযানটি প্রথম মঙ্গল অভিমুখে যাত্রা করে। সে যাত্রায় মানুষ ব্যর্থ হয়। এ যাবত চালানাে মােট ৫৫ টি বিভিন্ন ধরনের অভিযানের মধ্যে সফল হয়েছে মাত্র ২২ টি। তবুও মানুষ কখনাে মঙ্গলাভিযান থেকে সরে আসেনি।

মঙ্গল গ্রহ
image: bbc.com

একের পর এক উচ্চ বাজেটের প্রকল্প হাতে নিয়েছে মানুষ। সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যের ধনী রাষ্ট্র আরব আমিরাতের ভাইস প্রেসিডেন্ট শেখ মােহাম্মদ বিন রাশিদ আল মাকতুম, প্রধানমন্ত্রী ও দুবাইয়ের শাসক, গত ১৪ই ফেব্রুয়ারী দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত হওয়া পঞ্চম ওয়ার্ল্ড গভমেন্ট সামিটে এমনই একটি উচ্চাভিলাষী প্রকল্পের কথা বিশ্ববাসীর কাছে উপস্থাপন করেছেন। অথচ কয়েক দশক আগেও আরব আমিরাত ছিল
সমুদ্রোপকূলবর্তী একটি অনুন্নত অবহেলিত জেলেপল্লী। আবহাওয়া চরম ভাবাপন্ন। কিন্তু তেল সম্পদের আশীর্বাদ সেই অঞ্চলকে দুনিয়ার অন্যতম শীর্ষ আর উন্নত জনপদে পরিণত করেছে।



দুনিয়ার সবচেয়ে উঁচু ভবনটিও দুবাইয়ে রয়েছে। এই বাস্তবতা তাদের মঙ্গল অভিযানে বিশেষভাবে উৎসাহী করে তুলেছে। তারা প্রকল্পটির নাম দিয়েছে ‘মার্স ২১১৭’। অর্থাৎ প্রকল্প অনুসারে তারা আগামী ১০০ বছরের মধ্যে মঙ্গলগ্রহে একটি শহর তৈরি করবে। যেটি আয়তনে প্রায় শিকাগাে শহরের সমান হবে! যেখানে প্রায় ৬ লাখ মানুষ বাস করতে পারবে এবং যাদের সঙ্গে থাকবে খাদ্য, অক্সিজেন ও পরিবহন সুবিধা।

image: bbc.com

কিন্তু এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা মানুষের জন্য এতটা সহজ হবে না! কারণ আমরা জানি মঙ্গলগ্রহে যেরকম আবহাওয়া বিদ্যমান সেটা প্রাণীর জন্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিকর। সেজন্য লালগ্রহে বসবাসযােগ্য পরিবেশ তৈরীর জন্য প্রথমে সেখানে রােবট পাঠানাে হবে। ‘মার্স ২১১৭’ প্রজেক্টটি মূলত দুবাইয়ের শাসনকর্তা শেখ মুহাম্মদ বিন রাশিদ আল মাকতুমের ধারাবাহিক টুইট বার্তার মাধ্যমে বিশ্ব দরবারে উন্মােচিত হয়। শেখ মুহাম্মদ বলেন-

আমরা আজ যে বীজ বপন করতে যাচ্ছি, তার ফল ভােগ করবে পৃথিবীর পরবর্তী প্রজন্ম । নতুন জ্ঞানের আগ্রহই মানুষকে ভবিষ্যতের পর্দা উন্মােচন করতে সাহায্য করবে।

তিনি উল্লেখ করেন, ‘মার্স ২১১৭’ একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। “মাখতুম ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, প্রথম ধাপের কাজ হিসেবে তারা আমিরাতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলােতে মহাকাশ সম্বন্ধীয় শিক্ষা চালু করে তরুণদের মধ্যে মহাকাশ ভ্রমণে আগ্রহ বাড়াতে চায়। প্রকল্প বাস্তবায়নের ব্যাপারে শেখ মুহাম্মদ এক টুইট বার্তায় বলেন,”অন্য গ্রহের মাটিতে পা দেয়া মানবজাতির দীর্ঘ দিনের স্বপ্ন। আমাদের লক্ষ্য হলাে, সংযুক্ত আরব আমিরাত আন্তর্জাতিক অন্য সংস্থাগুলির সাথে অগ্রদূত হিসেবে কাজ করবে।”

মঙ্গলগ্রহ
মঙ্গলের মাটিতে আমিরাতে মহাকাশ যান; image: bbc.com

২০২২ সাল নাগাদ এটি জাপানের ‘Tanegashima Space Centre’ থেকে উৎক্ষেপণ করা হবে যেটি মঙ্গল গ্রহকে প্রদক্ষিণ করবে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রতিষ্ঠার ৫০তম বার্ষিকীতে ‘হােপ ২০২৩ সালে মঙ্গলে পৌঁছাবে। এই মিশনে কাজ হল মঙ্গলের এখনকার আবহাওয়া ও প্রাচীনকালের আবহাওয়ার মাঝে যােগসূত্র খুঁজে বের করা। এই অরবিটারটি পরবর্তী প্রায় তিনবছর ধরে লাল গ্রহটিকে প্রদক্ষিণ ও পর্যবেক্ষণ করবে।



শুরু থেকেই মহাকাশ ভ্রমণে মানুষের সবচেয়ে বড় বাঁধা হলাে দূরত্ব! তাই এই প্রজেক্টে দ্রুত গতির যােগাযােগ ব্যবস্থার দিকে বিশেষ নজর দেবার কথা বলা হয়েছে। পাথুরে লাল গ্রহে মানুষ কি আদৌ টিকতে পারবে? খাদ্যের যােগানই বা কীভাবে হবে? কিংবা যাতায়াত ব্যবস্থাই বা কেমন হবে? মঙ্গলে বসতি স্থাপনের পূর্বে এমন হাজার প্রশ্নের জন্ম নিয়েছে মানুষের মনে। একটি এমিরিটি প্রকৌশলীদের দল সাথে এক দল বিজ্ঞানী ও গবেষক সম্মিলিতভাবে মঙ্গলে শহরের একটি অংকিত নমুনা দেখান।

মঙ্গলে আমিরাতের কাল্পনিক শহর; image: getty image

অনুষ্ঠিত সম্মেলনে এই পরিকল্পনা দেখানাে হয়। এতে ঐ শহরের জীবনযাত্রা কীভাবে সচল রাখা হবে যেমন শহর কী করে তৈরি হবে, যাতায়াত ব্যবস্থা, শক্তি উৎপাদন, খাদ্য উৎপাদন এসবের ব্যাপারেও বিস্তারিত পরিকল্পনা দেখানাে হয়। যদিও এগুলাে বাস্তবায়নের নির্দিষ্ট কোনাে সময়সীমা তারা দিতে পারেনি। তবে আরব আমিরাতের প্রকৌশলীরা “হােপ” নামে একটি অরবিটার তৈরির কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। এটিই হবে আমিরাতের তৈরি প্রথম কোনাে স্পেসক্রাফ্ট।


মঙ্গল  গ্রহ প্রদক্ষিণ করার উদ্দেশ্যে ২০২২ সাল নাগাদ এটি জাপানের ‘Tanegashima Space Centre’ থেকে উৎক্ষেপণ করা হবে।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রতিষ্ঠার ৫০তম বার্ষিকীতে ‘হােপ’ ২০২৩ সালে মঙ্গলে পৌঁছাবে। এই মিশনের কাজ হল মঙ্গলের এখনকার আবহাওয়া ও প্রাচীনকালের আবহাওয়ার মাঝে যােগসূত্র খুঁজে বের করা। এই অরবিটারটি পরবর্তী প্রায় তিনবছর ধরে লাল গ্রহটিকে প্রদক্ষিণ ও পর্যবেক্ষণ করবে।

image: bbc.com

সংযুক্ত আরব আমিরাত স্পেস এজেন্সির পরিচালক মােহাম্মদ আল আধাবি বলেন” মঙ্গলের হােপ মিশনের কাজের নিয়মিত তদারকি হচ্ছে এবং এটি সঠিক সময়েই উৎক্ষেপণ সম্ভব হবে বলে আমরা আশা করছি।”

একটা সময় মহাশূন্য ভ্রমণ মানুষের কল্পনা ছিলাে। আমরা এখন জানি, মানুষ মহাশূন্য জয় করেছে প্রায় ৬ দশক হয়ে গিয়েছে। মহাশূন্য জয় কিংবা চন্দ্র বিজয় এগুলাে অনেক পুরনাে খবর । মানুষের তৈরি মহাকাশযান এখন গ্রহ-নক্ষত্রের সীমানা ছাড়িয়ে দূর-দূরান্তে অবিরাম ছুটে চলছে। মানুষ আজ মঙ্গলে চকচকে শহর তৈরির স্বপ্ন দেখছে ।



আরো পড়ুনঃ

টেলিস্কোপ এবং তার ইতিকথা

স্টোন ফিশঃ ছোট্ট দেহে এতো বিষ

আলোর গতি এবং বিজ্ঞানীদের মতবিরোধ

আরব আমিরাতের ‘মার্স ২১১৭’ প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমেই হয়তাে মানুষের সে স্বপ্নও একদিন পূরণ হবে । কিংবা মঙ্গলে বসতি গঠনের আরেক স্বপ্নদ্রষ্টা ইলন মাস্কের স্বপ্ন পূরণের মাধ্যমে মানুষ স্থায়ীভাবে লাল গ্রহের বাসিন্দা হয়ে যাবে।

মঙ্গলে আমিরাতের কাল্পনিক শহর; image: bbc.com

এদিকে গত ১৯শে ফেব্রুয়ারি রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষার পর নাসার মহাকাশযান পারসিভেয়ারেন্স-এর রোবট সফলভাবে মঙ্গল গ্রহের বুকে নামার পর সেখান থেকে ছবি পাঠাতে শুরু করেছে।

গ্রহের বিষুব অঞ্চল, যার নাম জেযেরো, তার কাছে গভীর এক গহ্বরে এই রোবটকে নামানো হয়েছে। নভোযানটি মঙ্গলের মাটি স্পর্শ করার মুহূর্তে উল্লাসে ফেটে পড়েন ক্যালিফোর্নিয়ায় নাসার মিশন কন্ট্রোলের প্রকৌশলীরা। ছয় চাকার এই রোবটযান আগামী দু’বছর মঙ্গল গ্রহ থেকে নমুনা সংগ্রহের কাজ করবে। প্রাচীন হ্রদ এলাকার মাটিপাথরের মধ্যে খনন চালিয়ে এটি অতীত অণুজীবের অস্তিত্ব সন্ধানের কাজ করবে।



ধারণা করা হয় জেযেরোয় কয়েকশো’ কোটি বছর আগে বিশাল একটি হ্রদ ছিল। সেই হ্রদে ছিল প্রচুর পানি, এবং খুব সম্ভবত সেখানে প্রাণের অস্তিত্বও ছিল। পারসিভেয়ারেন্সের রোবটযানটি প্রথম যে দুটি ছবি পৃথিবীতে পাঠিয়েছে, সে দুটি তোলা হয়েছে দুর্বল শক্তির প্রকৌশলী ক্যামেরা দিয়ে। ক্যামেরার লেন্সে ধুলার আস্তরণের মধ্যে দিয়ে পারসিভেয়ারেন্সর রোভার অর্থাৎ ওই রোবটযানের সামনে ও পেছনে সমতল ক্ষেত্র দেখা যাচ্ছে।

নাসার বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, রোবটযানটি জেযেরোর ব-দ্বীপের মত চেহারার একটি অংশের দুই কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে অবতরণ করেছে। এই এলাকাতেই পারসিভেয়ারেন্স তার সন্ধান কাজ চালাবে।

মেক্সিকো আন্তর্জাতিক অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল কংগ্রেসে ইলন মাস্ক তাঁর উপস্থাপনায় বলেন, “আমি মঙ্গলে গমন সারা জীবনের জন্য সহজতর করতে চাই। যেন যে কেউ চাইলেই সেখানে যেতে পারে। আমাদের কেউ লালগ্রহের বাসিন্দা হতে না পারলেও, হয়তাে আমাদের পরবর্তী কোনাে প্রজন্ম ঠিকই নিয়মিত মঙ্গলে যাতায়ত করবে নয়তাে সেখানে স্থায়ীভাবে বসতি গড়বে। যারা এতদূর পড়ে বিরক্ত হয়ে ভাবছেন, ‘ মঙ্গলগ্রহে মানুষের উপনিবেশ গঠনের ভাবনা নিছক বিলাসিতা ব্যতীত কিছু নয়, তাদের জন্য কার্ল সেগানের এই উক্তিটি

“If our long-term survival is at stake, we have a basic responsibility to our species toventure to other worlds.”


This is a Bengali article. This article is about the mission to Mars in the United Arab Emirates.

Necessary references are hyperlinked inside the article.

Featured Image: Getty Image

Total
0
Shares
Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous Article

টেলিস্কোপ এবং তার ইতিকথা

Next Article

আলোর গতি এবং বিজ্ঞানীদের মতবিরোধ

Related Posts

যেভাবে আমেরিকা পরিণত হলো বৈশ্বিক সুপার পাওয়ারে (পর্ব -২) : (ব্রেটন উডস কনফারেন্স থেকে বর্তমান)

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরই মূলত বিশ্বজুড়ে আমেরিকার প্রভাব স্থায়ী রুপ লাভ করে। ১৯৪৫ সালে ২৪শে অক্টোবর ৫১টি দেশের অংশগ্রহণে…
আরও পড়ুন

কিভাবে এলো আজকের সাবমেরিন?

সূচিপত্র Hide সাবমেরিনের ইতিহাস মিলিটারি নিউক্লিয়ার সাবমেরিন বামন সাবমেরিন ব্যক্তিগত সাবমেরিন গভীর সমুদ্র অপারেশনে সাবমেরিন সাবমেরিন এর নিউক্লিয়ার রিয়েক্টর এর কার্যপদ্ধতি সাবমেরিনের যুগে বাংলাদেশ…

হঠাৎ মানুষ বিলুপ্ত হয়ে গেলে কী ঘটবে পৃথিবীতে?

রাস্তার পাশ দিয়ে কঙ্কালের মতো দাঁড়িয়ে আছে আকাশচুম্বী অসংখ্য ধ্বংসপ্রাপ্ত ভবন। রাস্তা জুড়ে ছড়ানো ছিটানো কাগজ ,পলিথিন এবং…
আরও পড়ুন

উইঘুর নির্যাতন: একুশ শতকের ভয়াবহ গণহত্যায় নিরব কেন বিশ্ব?

উইঘুর মুসলিমদের ওপর আধুনিক পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর গণহত্যা চালাচ্ছে কমিউনিস্ট চীন। গণহত্যা এবং নির্যাতনের মাত্রা এত বেশি…

আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন

Total
0
Share