এই মুভির নামের বাংলা অর্থ দাঁড়ায় ‘নেশা থেকে বিরত থাকুন’ বা ‘নেশা ছেড়ে দিন’।‘মাত্থু ভাডালারা’ নামটি পরিচালক নিয়েছেন ১৯৬৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্তশ্রী কৃষ্ণা পান্ডাভেয়ামনামক মাইথোলজিক্যাল ফিল্মের একটি গান হতে। তেলুগু ভাষার এই চলচ্চিত্র মুক্তি পায় ২০১৯ সালের বড়দিনে। ২.১ কোটি রুপি বাজেটের বিপরীতে বক্স অফিসে এর পার্ফম্যান্স ছিলো খুব ভালো এবং প্রথম থেকেই পেয়েছে অনেক পজিটিভ রিভিউ৷ এটি তেলুগু সিনেমা যে একটি নতুন যুগে প্রবেশ করছে তার পরিচায়ক। হিউমার ও সাসপেন্সকে বুদ্ধিদীপ্তভাবে ব্যবহার করে আকর্ষণীয় ন্যারেটিভ সৃষ্টির মাধ্যমে দর্শককে মুগ্ধ করেছেন পরিচালক।
১৩০ মিনিট দৈর্ঘ্যের কমেডি/থ্রিলার জনরার এই মুভি নির্মাণের মাধ্যমে পরিচালনায় অভিষেক ঘটলো রিতেশ রানা’র। এতে চিত্রগ্রাহক হিসেবে কাজ করেছেন সুরেশ সারাঙ্গাম,এডিটিং করেছেন কার্থিকা শ্রীনিবাসএবং সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন কালা ভৈরবা।সিনেমাটির কাহিনীকারের দায়িত্বও সামলেছেন রানা, সাথে ছিলেন আর. তেজা।অ্যামাজন প্রাইম ভিডিওতে স্ট্রিমিং করে উপভোগ করা যাবে এটি। এর আইএমডিবি রেটিং ৮.২ এবং রটেন টমাটোজে অডিয়েন্স স্কোর ৯২%।
মাত্থু ভাডালারার ওপেনিং সিকোয়েন্স আপনার মনোযোগ আকর্ষণের জন্য যথেষ্ট। গল্পের শুরু হয় হায়দ্রাবাদের কোন এক স্থানে, ২০১৬ সালের অক্টোবরে। আমরা দেখতে পাই নোংরা অপরিচ্ছন্ন একটি রুম, যেখানে তিন বন্ধু একসাথে থাকে। রুমের মত তাদের পুরো ভাড়া বাসার অবস্থাও শোচনীয়। ছাদ থেকে পানি চুইয়ে চুইয়ে পড়তে দেখি আমরা। এমন সময় ঘুমন্তবাবু মোহন(শ্রী সিমহা)এর মুখের ওপর ক্যামেরা জুম ইন হয়। তার বন্ধুআভি(নরেশ আগাস্তি)ঘুম থেকে ওঠে এবং সাথে সাথেব্রেকিং ব্যাডএর একটি এপিসোড দেখতে বসে যায়, এই ব্রেকিং ব্যাডের বিশাল ভক্ত সে। হঠাৎ করে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে ঘুম থেকে উঠে পড়ে বাবু৷ ঘুম ভাঙ্গার কারণ ঘুমন্ত অবস্থায় তার হা করে রাখা মুখে ছাদের চুইয়ে পড়া পানি জমা হয়ে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গিয়েছিলো। তারপর সে টিভি চালায় এবং সেখানে একটি জনপ্রিয় তেলেগু টিভি সিরিয়াল চলতে দেখা যায়, যেখানে এক লোক মন্দিরে গিয়ে স্ত্রীর হাতে প্রসাদ খাওয়ার আগে মরতে অস্বীকৃতি জানায়; মাথায় গুলিবিদ্ধ হওয়া অবস্থায়ও সে তার স্ত্রীর সাথে কথা বলেই চলেছে!
এরকম একটা উদ্ভট, পাগলাটে এবং ট্রিপি পরিবেশের সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেন রানা। শেষ অংকে গিয়ে রহস্যের মীমাংসা হওয়া পর্যন্ত মুভিটি পুরোদমে ইন্টেন্সিটি আর সাসপেন্স ধরে রাখতে পেরেছে।
মাত্থু ভাডালারার গল্পের মূল ফোকাস লোভ এবং কিভাবে এটি প্রায়শই আমাদেরকে বিপদে ফেলে তার ওপর। মুভির এই মূল বক্তব্যকে ব্যাখ্যা করার জন্য পরিচালক আমাদেরকে খুব কাছ থেকে দেখিয়েছেন বাবু এবং তার অপর রুমমেট ইয়েসু দাসু (সাত্যিয়া)এর জীবনপ্রণালিকে। তারা উভয়েই ডেলিভারি এক্সিকিউটিভ হিসেবে কাজ করে কিন্তু নিজেদের স্বল্প আয় নিয়ে তারা খুবই হতাশ৷ কারণ এত কম টাকায় তারা নিজেদের পছন্দমত জিনিসপত্র কিনতে পারে না, পাশাপাশি বাড়ীর মালিকসহ অনেকের গঞ্জনা শুনতে হয় এবং ঝামেলা পোহাতে হয়। এমতাবস্থায় বাবু ঠিক করে সে সবকিছু ছেড়ে-ছুড়ে গ্রামে চলে যাবে। তখন ইয়েসু তাকে থেকে যেতে রাজি করায় এবং বলে সে তাকে কিছু ট্রিক শিখিয়ে দেবে, যেগুলো ব্যবহার করে প্যাকেজ ডেলিভারি করার সময় সে বাড়তি টাকা আয় করতে পারবে।
যখন বাবু বুঝতে পারে যে ইয়েসু গ্রাহকদের সাথে প্রতারণা করে টাকা আয় করছে, তখন এই পন্থা অবলম্বন করবে কিনা সেটা নিয়ে সে নৈতিক দ্বন্দ্বে পড়ে। কিন্তু পরের দিন আমরা দেখি সে চাকরি চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবং বন্ধুর বাতলিয়ে দেওয়া ট্রিক ব্যবহার করে টাকা উপার্জনে ব্রতী হয়। কিন্তু সে কি আর জানতো এই পথে চলতে গিয়ে তার জীবনের গতিপথ কিভাবে পুরোপুরি পাল্টে যাবে?!
ঘটনাক্রমে প্যাকেজ ডেলিভারি দিতে গিয়ে সে একজন প্রবীণ মহিলাকে খুন করে বসে, ঐ মহিলার বাড়ীতে আটকা পড়ে এবং কয়েক ঘন্টা নেশার ঘোরে কি হয় সে সম্পর্কে তার কোন হদিস থাকে না। এরপর নেশার ঘোর কাটিয়ে যখন সে জেগে ওঠে, তখন তার পাশে আরেকটি মৃতদেহ আবিষ্কার করে। গল্পের পরের অংশে কেমন করে বাবু কি ঘটেছে তা মনে করে এবং এই রহস্যের জট খোলে তা বর্ণিত হয়েছে।
নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে মুভি প্রথম ভাগ সাসপেন্স এবং কমেডির এক অসাধারণ মিশ্রণ। ফিল এবং টেনশনের দিক থেকে রিতেশ রানার মাত্থু ভাডালারাই কার্তিক সুব্বারাজএর পিজ্জা (২০১২)এর আবহ রিক্রেশনে সবচেয়ে কাছাকাছি গিয়েছে। পিজ্জা মুভিতে আমরা বিজয় সেথুপতি‘কে একজন পিজ্জা ডেলিভারি বয়ের চরিত্রে দেখেছিলাম, যে পিজ্জা ডেলিভার করতে গিয়ে একটি বাসায় আটকা পড়ে।
যদিও হরর এলিমেন্ট ক্রিয়েট করার ক্ষেত্রে মাত্থু ভাডালারা পিজ্জার পথ অনুসরণ করে না। বরং এখানে ঘটনাসমূহ ঘটে দিনের আলোতে এবং এই মুভিতে রিতেশ রানা যে ধরনের থ্রিল জেনারেট করেন, সেক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সহায়তা করে হঠাৎ করে উদ্ভূত একটি অস্বাভাবিক পরিস্থিতি; যে পরিস্থিতিতে বাবুকে একটা ক্রাইম সিন পরিষ্কার করতে হয়।
একদিক থেকে ধরতে গেলে রিতেশ রানার ফিল্মমেকিং স্টাইলের সাথে এডগার রাইটএর ফ্যান্টাসি অ্যাকশন ফিল্ম স্কট পিলগ্রিম ভার্সেস দ্যা ওয়ার্ল্ড (২০১০)এর কিছুটা মিল রয়েছে। এবং নতুনভাবে গল্প বলার ক্ষেত্রে কোন স্টাইল ফলো করবেন তার ওপর এই ডেব্যুট্যান্ট ডিরেক্টরের দৃঢ় নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। ওপেনিং সিকোয়েন্সে আমরা যে টিভি সিরিয়ালটি চলতে দেখি, সেটি সময় গড়ানোর সাথে আরো উদ্ভট হতে থাকে। কখন কোন ঘটনা ঘটছে তার রেকর্ড রাখার ক্ষেত্রে এটি টাইম-স্ট্যাম্পের মত কাজ করে আর পরিচালকের স্টোরি টেলিংয়ের উপকরণসমূহের মধ্যে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ন্যারেটিভের ফ্লো ভেঙ্গে অপর একটি দৃশ্যে যাওয়ার ক্ষেত্রে চমৎকারভাবে ব্যবহৃত হয়েছে এই সিরিয়ালটি৷
মুভির প্রথমদিকে বাবু যেসব কাজ এবং ভুল করে, পরের অংশে সেগুলোই টুইস্ট হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এবং সাসপেন্স বিল্ডিংয়ের সময় তার এইসব কর্মকাণ্ডই দর্শককে সবগুলো দৃশ্য মনোযোগ দিয়ে অবলোকন করতে বাধ্য করে। কিন্তু মুভির টোন ততটা সিরিয়াস হয়না, কেননা দর্শকরা যে সাসপেন্স থ্রিলারের আদলে একটি বিচিত্র কমেডি ফিল্ম দেখছেন সেটি সাত্যিয়া কখনোই ভুলতে দেয় না।
মুভির রানটাইম প্রায় ১৩০ মিনিটের এবং মাত্থু ভাডালারা কোন খামতি ছাড়া ১১০ মিনিটের মত দর্শককে মোহিত করে রাখে, যা পরিচালকের প্রথম কাজ হিসেবে বাহবা পাওয়ার দাবী রাখে। কিন্তু যখনই রহস্যের যবনিকাপাতের সময় হয়, তখনই মুভিটি ভিন্ন দিকে ধাবিত হয়। এই অবস্থায় দর্শকের মনে হতে পারে ব্যাকস্টোরিতে খামতি আছে। কেননা এই জায়গায় এসে মুভিতে যে এতক্ষণ পর্যন্ত একটা চনমনে ভাব ছিলো, সেটি ম্লান হয়ে যায় কিছুটা। এখানে এসে মুভিটিকে পরিচালক একটু সিরিয়াস টোন দিতে চান যা মুভির প্রথমদিকের লাইট টোনের সাথে একটু বেখাপ্পা দেখায়৷ মুভির শেষ অংশ দর্শকদের মনে কিছুটা নীরস ভাব নিয়ে আসতে পারে। আর মুভির ক্ল্যাইম্যাক্সে আমরা যে সেখানে উপস্থিত সবাইকে আক্ষরিকভাবে হাই হতে দেখি, সে দৃশ্যও আগের টোন পুনরুদ্ধারে খুব একটা সহায়তা করতে পারে না।
তবে সামগ্রিকভাবে পুরো মুভিতে রিতেশ রানা এবং তার ক্রু যে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন, সেটিকে ছোট করে দেখার কোন উপায় নেই। এই মুভি আপনাকে টানটান উত্তেজনা যেমন দেবে, তেমনি হাসাবেও। পপ কালচার বা পপুলার কালচারের রেফারেন্সের ব্যবহার করার ফলে এর ফিলোসোফিকে মানুষের কাছে প্রাঞ্জলভাবে ফুটে উঠেছে। তাই এটি না দেখাটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না বলে মনে হয়।
এই মুভির কাস্টিং একেবারে টপ নচ। নৈতিক টানাপোড়ন এবং উটকো ঝামেলা থেকে কিভাবে রক্ষা পাবে সেটি নিয়ে দিশেহারা বাবু মোহনের চরিত্রে ঔজ্জ্বল্য ছড়িয়েছেন শ্রী সিমহা। তবে একেবারেরিব-টিকলিংকমেডি দিয়ে সমস্ত আলো নিজের দিকে টেনে নিয়েছেন সাত্যিয়া। নিজের চরিত্রের রূপায়ণে কৃতিত্বের সাক্ষর রেখেছেন নরেশ আগাস্তিও।মাইরাহ্চরিত্রেআথুলিয়া চন্দ্রারপার্ফম্যান্সও ছিলো উল্লেখযোগ্য।ভেনেলা কিশোর, বিদ্যুলেখা রমন, ব্রাহ্মজী, পাভালা শ্যামলা, অজয় ঘোষ, জিভাএদের সবার অভিনয়ও ভালো ছিলো।
পরিচালক রানার মত সঙ্গীত পরিচালক কালা ভৈরবারও এটি ছিলো অভিষেক চলচ্চিত্র। বলতে গেলে অভিষেকই বাজিমাত করেছেন তিনি। তার করা ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর ছিলো অসাধারণ, যা সাসপেন্সের আবহ তৈরীতে সাহায্য করেছে ব্যাপকভাবে।
সিনেম্যাটোগ্রাফি আর স্ক্রিপ্টিংয়েও ভালো নাম্বার পাবে মাত্থু ভাডালারা। এই ধরণের প্রজেক্ট সফল হওয়ার জন্য যে ধরণের সিনেম্যাটোগ্রাফি দরকার ঠিক তা-ই ডেলিভার করেছেন সুরেশ সারাঙ্গাম। তবে এই মুভির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার মনে হয় রিতেশ রানার মত প্রতিশ্রুতিশীল নতুন ট্যালেন্টের আগমনী বার্তা মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া। তার ট্যালেন্টের স্বরুপ প্রকাশিত হয় কিছুটা নীরস তৃতীয় অংকের পরেও তিনি যেভাবে হাই নোটে গল্পটি শেষ করেন তার মধ্য দিয়ে। এটাই তার মাস্টারস্ট্রোক।
মাত্থু ভাডালারা দর্শককে লোভ, টাকা-পয়সা, জীবন বদলে দেওয়া সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে অনেক বেশি ভাবতে উদ্বুদ্ধ করবে। মুভিতে আমরা আরো একবার রিতেশ রানাকে টাইম-স্ট্যাম্প ব্যবহার করতে দেখি৷ তখন নভেম্বরের ৮ তারিখ এবং ক্যামেরা ফোকাস করে টিভিতে চলমান একটি স্পীচের ওপর। আর ঠিক তখনই আপনি বুঝতে পারবেন এই মুভি আসলে অলসতা ছেড়ে কর্মচঞ্চল হওয়া বা মাদক থেকে দূরে থাকা নিয়ে অতটা মাথা ঘামায় না৷ বরং এই মুভির লক্ষ্য আপনার অমনোযোগীতা ও তন্দ্রাভাব কাটানো এবং পরিপার্শ্বের দিকে আরো ভালোভাবে তাকাতে আগ্রহী করে তোলা৷