প্রাচীন ভারতের মৌর্য সাম্রাজ্যের রাজ-পরামর্শক কৌটিল্যের একটি নীতি বাক্য ছিল। আর তা হলো, ‘প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করে দাও, দরকার হলে গুপ্তহত্যা করেও।’ নীতিবাক্যটি প্রাচীন মৌর্য সাম্রাজ্যে প্রচলিত থাকলেও, কয়েক সহস্র বছর পরের এই আধুনিক বিশ্বে এখনো অনেক দেশের রাষ্ট্রনীতিতে এর উপস্থিতি দেখা যায়। একটি রাষ্ট্র কীভাবে আরেকটি রাষ্ট্রের উপর ক্ষমতার প্রাধান্য বিস্তার করতে পারে- এটিই ছিল কৌটিল্যের কূটনীতির মূলনীতি। তার কূটনীতির অপরিহার্য একটি অংশ ছিল গুপ্তহত্যা। যুগের পর যুগ রাজনীতি বা কূটনীতিতে এই কৌশল ব্যবহার হয়ে আসছে বিশ্বজুড়ে।
মোসাদ ইসরায়েলের গোপনীয় গোয়েন্দা সংস্থা। পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্ধর্ষ ও গুপ্ত সংঘগুলোর মধ্যে অন্যতম মোসাদ। গত শতকে অনেক গুপ্তহত্যা ঘটিয়েছে ইসরায়েলের এই গোয়েন্দা সংস্থা। ফিলিস্তিনি মুক্তি আন্দোলন থেকে শুরু করে মিত্ররাষ্ট্রের যেসব নীতিনির্ধারক ইসরায়েলের স্বার্থের পরিপন্থি তাদেরও বাদ দেয়নি মোসাদ। তারা গুপ্তহত্যাকে এমন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল যে, মৃতদেহ বাদে আর কোনো প্রমাণই পাওয়া যেত না। মোসাদ তাদের মিশনগুলো এত নিখুঁত এবং দক্ষতার সাথে সম্পাদন করে, অনেক সময় মৃত ব্যক্তির পরিবার কিংবা পুলিশ কল্পনাই করতে পারে না যে এই হত্যার পিছনে কোন গুপ্তসংঘের হাত ছিল। বরং, অনেক ক্ষেত্রে স্লো পয়জন প্রয়োগে হত্যাকাণ্ডকে অনেকটা স্বাভাবিক মৃত্যু বলেই মনে হয়। কিন্তু এত নিঁখুতভাবে গুপ্তহত্যার কাজটি কিভাবে করে মোসাদ? ‘বিশ্বের সবচেয়ে কার্যকরী হত্যাযন্ত্র’ খ্যাত মোসাদের শিকার থেকে রেহাই পাননি বিজ্ঞানীরাও। শত্রুদেরকে প্রযুক্তিগত দিক থেকে এগিয়ে নিতে পারবে এমন অনেককেই লক্ষ্য বানায় মোসাদ। তারপর সুযোগ বুঝে ঘায়েল করা হয়। সর্বেশেষ মোসাদের গুপ্তহামলায় প্রাণ হারিয়েছেন “ইরানের পরমাণুর জনক” খ্যাত বিজ্ঞানী মোহসিন ফাখরিযাদে।
মোসাদের পরিচয়
মোসাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৪৯ সালের ১৩ই ডিসেম্বর। প্রতিষ্ঠাকালে সংস্থাটির নাম ছিল “দ্য সেন্ট্রাল ইন্সিটিটিউট ফর করডিনেসন”। ১৯৫১ সালে সংস্থাটি নাম পরিবর্তন করে “দ্য ইন্সিটিটিউট অফ ইনটেলিজেন্স অ্যান্ড স্পেশাল অপারেশনস” বা মোসাদ (Mossad) নামে কার্যক্রম শুরু করে। মোসােদ কেবলমাত্র ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর কাছেই জবাবদিহি করে থাকে। খোদ প্রধানমন্ত্রীর কাছেই তাদের কাজের প্রতিবেদন পেশ করে।
ইসরায়েলের সীমানার বাইরে গোপনে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করা, শত্রুভাবাপন্ন দেশগুলো যাতে বিশেষ ধরনের অস্ত্র তৈরি বা সংগ্রহ করতে না পারে তা নিশ্চিত করা, দেশে-বিদেশে ইসরায়েলি লক্ষ্যবস্তুর উপর হামলার ষড়যন্ত্র আগাম প্রতিরোধ করা, যেসব দেশে ইসরায়েলের অভিবাসন সংস্থা আইনত সক্রিয় হতে পারে না, সেই সব দেশ থেকে ইহুদিদের ইসরায়েলে নিয়ে আসার দায়িত্ব পালন করাই মোসাদের মূল দায়িত্ব। মোসাদ তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে মোট আটটি বিভাগের মাধ্যমে। এর মধ্যে পাঁচটি বিভাগ সম্পর্কে কিঞ্চিৎ জানা যায়। বাকিগুলো সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। কালেকশন ডিপার্টমেন্ট:এটি মোসাদের সবচেয়ে বড় বিভাগ। বহির্বিশ্বে ডিপ্লোম্যাট, ব্যবসায়ী, টুরিষ্ট এবং সাংবাদিকসহ অন্যান্য ছদ্মবেশে কাজ করেন এই বিভাগের এজেন্টরা। পলিটিক্যাল অ্যাকশন ডিপার্টমেন্ট:এ গ্রুপের কাজ প্রতিটি বন্ধুভাবাপন্ন দেশের গোয়েন্দা ও গুপ্তচর সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় রক্ষা করা। স্পেশাল অপারেশন ডিপার্টমেন্ট:এই গ্রুপকে গুপ্তহত্যার কাজে ব্যবহার করা হয়। বেপরোয়া গুপ্তহত্যা চালিয়ে পথের কাটা দূর করাই এই ডিপার্টমেন্টের প্রধান কাজ। ল্যাপ ডিপার্টমেন্ট: এই গ্রুপ প্রতিপক্ষের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের জন্য প্রচার চালায় ও শত্রু শিবিরে ভুল খবর ছড়িয়ে বিভ্রান্তি তৈরি করে।
রিসার্চ ডিপার্টমেন্ট:যাবতীয় গোয়েন্দা গবেষণা ও ‘কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স’-এর ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ বৃদ্ধির নিরন্তর কাজ করে চলেন এই গ্রুপের গবেষকরা। মোসাদের নীতিমালা ও কার্যক্রম অনেকটা যুক্তরাষ্ট্রের সিআইএ, যুক্তরাজ্যের এমআই৬ ও কানাডার সিএসআইএস এর অনুরূপ। তবে বেপরোয়া কার্যক্রমের দিক দিয়ে মোসাদ সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে। বর্তমানে সংস্থাটির প্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন ইয়োসি চোয়েন। বিভিন্ন গণমাধ্যমের বিশ্লেষণে জানা যায় মোসাদের বর্তমান কর্মীসংখ্যা আনুমানিক ৭০০০-এর মতো। ইসরায়েলের তেলআবিবে সংস্থাটির সদর দপ্তর অবস্থিত। সংস্থাটির বাৎসরিক বাজেট ২.৭৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। মোসাদ এ পর্যন্ত প্রায় ৮০০ বিজ্ঞানী, গবেষক, শিক্ষাবিদ এবং ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী নেতাদের গুপ্তহত্যা করেছে। তবে তাদের বেশকিছু মিশন ব্যর্থও হয়েছে। ১৯৮০ হতে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত মোসাদ দুর্দান্ত আকারে “প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন” বা পিএলও-এর নেতাদের হত্যা করে। এর ফলে ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে যায় পিএলও-এর স্বাধীনতা সংগ্রাম। উল্টা পথে হামাসের উত্থান হতে থাকে। সে সময় হামাসের উদীয়মান নেতা খালিদ মিশাল অনেক বড় হুমকি হিসেবে দেখা দেয় ইসরায়েলের জন্য।
১৯৯৭ সালে খালিদ তার গাড়ি হতে নেমেই হামাস অফিসে ঢুকবে, ঠিক এ সময় হাতে ব্যান্ডেজ লাগানো তিন জন কানাডিয়ান টুরিস্ট তার গাড়ির পাশেই দাড়িয়ে ছিল। একজন টুরিষ্ট(মোসাদের স্পাই) হঠাৎ খালিদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে তার কানে কিছু একটা পুশ করতে চেষ্টা করে। বিষ ঢেলে দিয়েছিল তার শরীরে।হাসপাতালে ভর্তি করা হলো তাকে। খালিদের অবস্থা ধীরে ধীরে খারাপ হতে থাকে, অবস্থা এমন হলো যে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তিনি হয়তো মারা যাবেন। জর্ডানের বাদশাহ হোসাইন এবার সরাসরি ফোন দেয় ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে। স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন যদি খালিদ মিশাল মারা যায়, তাহলে তিন মোসাদ স্পাইকে খুন করা হবে, এবং ইসরায়েলের সাথে শান্তি চুক্তি বাতিল করা হবে। এবার মোসাদ সতর্ক হয়ে উঠে। মোসাদের চীফ নিজেই ল্যাবরেটরীতে মডিফাই করা বিষের প্রতিষোধক নিয়ে আম্মানে আসেন। খালিদ মিশাল সুস্হ হয়ে উঠেন। এই ব্যর্থ হামলার ফলাফল এমনই করুন ছিলো যে মোসাদের চীফকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। খালিদ মিশালের উপর এই হামলায় মোসাদের সাথে কানাডার গোয়েন্দা সংস্হা সিএসআইএস জড়িত ছিল বলে মনে করা হয়।
যেভাবে হত্যাকাণ্ড ঘটায় মোসাদ
কোনো ব্যক্তিকে টার্গেট হিসেবে চিহ্নিত করার পর মোসাদ তাকে হত্যা করা হবে কি না সে ব্যাপারে যাচাই-বাছাই করে। মোসাদ যদি মনে করে ওই ব্যক্তির বেঁচে থাকা ইসরায়েলের জন্য হুমকির কারণ হবে, তাহলে তাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এরপর মোসাদের বিশেষজ্ঞ দল ওই ব্যক্তির ফাইলটি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর অভিভাবক সংস্থা ‘ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস কমিটি’র প্রধানের কাছে পাঠিয়ে দেয়। এই সংস্থাটি হিব্রু ভাষায় ‘ভারাশ’ নামে পরিচিত।
এ বিষয়ে আলোচনা করে নিজেদের মতামত ও পরামর্শ দেয় ভারাশ। তবে এই অপারেশন অনুমোদনের ক্ষমতা নেই তাদের। এই ক্ষমতা রয়েছে শুধু ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর। প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে প্রতিরক্ষামন্ত্রীসহ দুই-একজনের সাথে পরামর্শ করেন। অনুমোদনের পর বিষয়টি আবার মোসাদের কাছে যায় পরিকল্পনা ও প্রস্তুতির জন্য। কখনো কখনো এতে এক সপ্তাহ থেকে কয়েক বছর পর্যন্ত সময় লাগে। বিষয়টি নির্ভর করে টার্গেটের অবস্থান ও তার নিরাপত্তার ওপর। মোসাদের অত্যন্ত গোপন একটি বাহিনী ‘কায়সারিয়া ইউনিট’। আরব বিশ্বসহ বিভিন্ন দেশে গুপ্তচর মোতায়েন করাই তাদের কাজ। ১৯৭০-এর দশকে এই ইউনিটটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ইসরায়েলি গোয়েন্দা কর্মকর্তা মাইক হারারি। আরব বিশ্বসহ মধ্যপ্রাচ্যের সর্বত্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ টার্গেটের ওপর নজরদারি ও তথ্য সংগ্রহ করে কায়সারিয়া। এই ইউনিটের মধ্যে আবার রয়েছে ‘কিডন’ নামে একটি বাহিনী। যেকোনো ধরনের হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞে পারদর্শী পেশাদার খুনিদের একটি দল কিডন। ইসরাইলি সেনাবাহিনী ও স্পেশাল ফোর্সের সদস্যদের মধ্য থেকে সাধারণত এই লোকদের নেয়া হয়। ফিলিস্তিনি বিজ্ঞানী ফাদির হত্যাকারীরা সম্ভাব্য কিডন সদস্য বলে জানিয়েছে বিভিন্ন সূত্র। কায়সারিয়া ইউনিটের কাজ অনেকটা যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর স্পেশাল এক্টিভিটিস সেন্টারের (এসএসি) মতো। এসএসি’র মধ্যে আবার স্পেশাল অপারেশন গ্রুপ (এসওজি) নামে একটি ইউনিট রয়েছে যারা হত্যাকাণ্ড চালায়। সিআইএ’র এসওজি আর মোসাদের কিডন একই ধরনের ইউনিট। রোনেন বার্গম্যান-“দ্বিতীয় ইন্তিফাদার আগ পর্যন্ত ইসরায়েল অন্তত ৫০০ হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে যাতে নিহত হয়েছে অন্তত এক হাজার টার্গেট ও অন্যরা। আর দ্বিতীয় ইন্তিফাদার সময় তারা এক হাজারের বেশি অপারেশন চালিয়েছে যার মধ্যে ১৬৮টি সফল হয়েছে। সব মিলে সেই থেকে হামাসের নেতাদের বিরুদ্ধে সংস্থাটি ৮০০টির বেশি হামলা চালিয়েছে। তবে মোসাদের টার্গেট যে শুধু ফিলিস্তিনিরা তা নয়, সিরিয়া, লেবানন, ইরান এমনকি ইউরোপের কোনো নাগরিককেও হত্যা করতে পারে সংস্থাটি। মোট কথা ইসরায়েল বা ইহুদিবাদীদের স্বার্থের বিরুদ্ধে রয়েছে এমন যে কাউকে হত্যা করতে পারে এই সংস্থাটি।
অপারেশন ডেমোক্লিস
অপারেশন ডেমোক্লিস হলো ইসরায়েলের বিজ্ঞানী নিধন প্রক্রিয়া। তবে সেটা নিজের দেশের বিজ্ঞানী নয়। পৃথিবীর যে দেশগুলো ইসরায়েলের জন্য হুমকির কারণ হয়ে উঠেছে, সে দেশগুলো যেন প্রযুক্তিকভাবে কখনোই শক্তিশালী হয়ে উঠতে না পারে এ কারণে ইসরায়েল গণহারে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীদের গুপ্ত হামলায় হত্যা করে। আর ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ এই মিশনের নাম দেয় অপারেশন ডেমোক্লিস।
পর পর কয়েকটি যুদ্ধে ইসরায়েলের কাছে নাস্তানাবুদ হয়ে মিশরের প্রেসিডেন্ট জামাল আবদেল নাসের বুঝতে পারেন, প্রযুক্তিতে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। নাৎসি জার্মানির ভি-টু রকেট প্রজেক্টে কাজ করা অনেক প্রকৌশলী ও বিজ্ঞানীকে নিয়ে মিশর নিজেদের রকেট প্রজেক্ট শুরু করে। ১৯৬২ সালে নতুন রকেটের সফল পরীক্ষার পর গোটা বিশ্ব নড়ে বসে। সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীদের পরিবারকে ক্রমাগত হুমকি দিতে শুরু করে মোসাদ।
২৭ নভেম্বর রকেট বিজ্ঞানী ওলফগ্যাং পাইলজের অফিসে একটি পার্সেল বোমা পাঠানো হয়েছিল, যার বিষ্ফোরণে আহত হয় তার সহকারী। মিশরে মিলিটারি হার্ডওয়্যার সরবরাহ করা হেইঞ্জ ক্রুগ অপহৃত হন। তাকে আর খুঁজেই পাওয়া যায়নি। মিশরের এক রকেট কারখানায় পার্সেল বোমায় নিহত হয় ৫ কর্মী। বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানীর উপর গুলি চালানো হয়। আতঙ্কিত হয়ে ১৯৬৩ সালের শেষ নাগাদ বিজ্ঞানীদের একটি বড় অংশ ইউরোপে ফেরত যান। স্থবির হয়ে যায় এই প্রজেক্ট। এই অপারেশনের আদলে হত্যা করা হয় ইরানের বহু পরমাণু বিজ্ঞানীকে। এছাড়া সিরিয়া এবং লেবাননের অনেক বিজ্ঞানীও গুপ্ত হামলার শিকার হয়। কিন্তু জায়নবাদী ইসরায়েল কখনোই তাদের এই গুপ্তহত্যা কথা স্বীকার করেনি।
This is a Bangla Article. This is About Mossad: The most Mighty intelligence agency in the world (1st Part)
All the references are hyperlinked within the article.
Featured Image: Middle East Monitor