ধরুন, আপনি হাঁটছেন প্রবাল দ্বীপে। বন্ধুদের সাথে গল্প করছেন। সাগরের নোনা জলে দাপাদাপি করছেন, এমন সময়ে আপনি দেখলেন একটা অনিন্দ্য সুন্দর প্রবাল। যেই আপনি ধরতে গেলেন সেই প্রবালটাকে, তখনই প্রবাল থেকে কাঁটা বের হয়ে আপনাকে গুতো দিল। আর আপনি যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে পড়লেন। আবার এমন হতে পারে আপনার কোনাে বন্ধু হাঁটছে প্রবাল
দ্বীপে। হঠাৎ সে চিৎকার করে উঠল যন্ত্রণায়। দুটি ক্ষেত্রেই যা হতে পারে তা হল আপনারা স্টোন ফিশের কবলে পড়েছেন।
প্রবাল এবং প্রবাল দ্বীপ সম্পর্কে আমাদের কারোরই অজানা নয়। প্রবাল দ্বীপ হলো এমন এক প্রকার দ্বীপ যা প্রবাল ছাইভস্ম এবং এ জাতীয় জৈব পদার্থ দিয়ে গঠিত হয়েছে। এগুলো গ্রীষ্মমন্ডলীয় এবং উপ-গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলে দেখা যায়, সাধারণত প্রবাল প্রাচীরের অংশ হিসাবে যা সমুদ্রের নিচে একটি বৃহত্তর অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত থাকে। জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও মাছের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য প্রবাল গুরুত্বপূর্ণ, সুতরাং প্রবাল প্রাচীরগুলো রক্ষা করাও গুরুত্বপূর্ণ। প্রবাল প্রাচীরগুলো অ্যানথ্রোপোজেনিক প্রভাবের হুমকির মধ্যে রয়েছে, এর কয়েকটি ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাপী বড় প্রভাব ফেলেছে।
বিশ্বের বেশিরভাগ প্রবাল দ্বীপপুঞ্জই প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত। আমেরিকার জারভিস, বাকের এবং হাওল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ প্রবাল দ্বীপের সুস্পষ্ট উদাহরণ। ভারতের লক্ষদ্বীপের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলটিতে ৩৯টি প্রবাল দ্বীপপুঞ্জ এবং কয়েকটি ছোট দ্বীপ এবং ব্যাংক রয়েছে। এছাড়াও, কিরিবাতির অন্তর্গত কয়েকটি দ্বীপ প্রবাল দ্বীপ হিসাবে বিবেচিত হয়। মালদ্বীপেও প্রবাল দ্বীপ রয়েছে। সেন্টমার্টিন দ্বীপটি বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ যা আয়তনে ৮ বর্গকিলোমিটার।
যাই হোক, আজ আমরা জানব প্রবাল দ্বীপের এক ভয়ংকর প্রাণী সম্পর্কে। যা দুই ঘন্টার মধ্যেই কোন মানুষের মৃত্যু ঘটিয়ে ফেলতে পারে। স্টোন ফিশ। দেখতে খুবই সুন্দর। অনেকটা প্রবাল পাথরের মতাে। যে কোনাে মানুষ প্রায়ই ভুল করবে একে পাথর থেকে আলাদা করতে। এজন্যই এদের নাম
স্টোন ফিশ।
স্টোন ফিশের অনেকগুলাে প্রজাতি রয়েছে। প্রজাতি ভেদে আকারও বিভিন্ন প্রকার হয়ে থাকে। তবে সাধারণত এরা লম্বায় ১৪ থেকে ২০ ইঞ্চি হয়। আর ওজনে সর্বোচ্চ পাঁচ পাউন্ড। কিলােগ্রামের হিসেবে আড়াই কিলােগ্রামের মতাে ওজন হয় । ভাবতেই অবাক হতে হয়, ছােট্ট দেহে এত বিষ!
সাধারণত মাছের পিঠে যে রকম পাখনা থাকে, এদেরও তেমন থাকে। আর সেই পাখনায় থাকে ১৩টি ধারাল কাঁটা আর দুটি বিষথলি। তারা সাধারণত কাঁটা দিয়ে আক্রমণ করে না।
এরা আক্রান্ত বা বিপদগ্রস্থ হলেই কাঁটা ফুটিয়ে দেয়। এগুলাে ছাড়াও এদের শরীরের অন্যান্য স্থানে পাঁচ-ছয়টি কাঁটা পুরু চামড়ার আড়ালে লুকানাে থাকে। সবগুলাে কাঁটাই এরা প্রতিরক্ষার কাজে ব্যবহার করে। একবার বিষথলি খালি হলে পুনরায় পূর্ণ হতে কয়েক সপ্তাহ সময় লাগে।
স্টোন ফিশ কোন মানুষকে দংশন করলে অল্প সময়ের মধ্যেই মানুষের মৃত্যু হতে পারে। এটা নির্ভর করে কতটা বিষের অনুপ্রবেশ হয়েছে এবং বিষ কতটা গভীরে পৌঁছেছে তার ওপর। শরীরে বিষ প্রবাহিত হলেই প্রচন্ড যন্ত্রণা হয় । মুহূর্তেই আক্রান্ত ব্যক্তির চেহারা ও শরীর ফুলে যায়। সবচেয়ে বড় সমস্যা হয় বিষ রক্ত সঞ্চালন সিস্টেমকে প্রভাবিত করার কারণে। ফলে প্রয়ােজনীয় অক্সিজেন মস্তিষ্কে পৌঁছতে পারে না। আর এতেই আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যু ত্বরান্বিত হয়।
সাধারণত যে লক্ষণগুলাে দেখে আমরা বুঝতে পারবাে এটা স্টোন ফিশের দংশন সেগুলাে হলাে-
- তীব্র যন্ত্রণা।
- আক্রান্ত স্থান লাল হয়ে যাওয়া। অনেকটা ফুসকুড়ির মতাে।
- ক্ষতস্থান ফুলে যাওয়া এবং ফোস্কার মতাে হয়ে যাওয়া।
- মাথা ব্যথা।
- ব্লাড প্রেসার কমে যাওয়া।
- শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা। স্বাভাবিকভাবে শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া।
- মাসল ক্রাম্পসকে আমরা সাধারণত রগ টান লেগেছে বলে থাকি।
- বমি করা অথবা বমি বমি ভাব এবং পাতলা পায়খানা হওয়া।
- তীব্র ক্লান্তি ও অসাড়তা।
কেউ যদি হঠাৎ এভাবে আক্রান্ত হয় তাহলে প্রথম করণীয় হলাে তাকে পানি থেকে উঠিয়ে নিয়ে আসা। আক্রান্ত ব্যক্তি যন্ত্রণায় এতটাই কাতর হয়ে পড়বে যে তার নিজে উঠে আসার শক্তি থাকবে না। এক্ষেত্রে সে পানিতে ডুবে যেতে পারে। এজন্য প্রথম কাজই হলাে পানি থেকে বা আক্রান্ত স্থান থেকে সরিয়ে নিরাপদ স্থানে নিয়ে আসা। পরবর্তী কাজ হলাে যথাসম্ভব দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া। ঘটনার সময় মনে রাখতে হবে যাতে ডাক্তারকে জানানাে যায়। কতক্ষণ ধরে অসুস্থ সেটা জানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যা ডাক্তারের চিকিৎসার জন্য প্রয়ােজনীয় হবে।
বাংলাদেশ বা এশিয়ার মানুষ হিসেবে আমাদের ভয় না পাওয়ার কারণ আমাদের এদিকে এই মাছের দেখা মিলে না। সাধারণত অস্ট্রেলিয়ায় এদের দেখতে পাওয়া যায়। গ্রেট ব্যারিয়ার রীফ, সবচেয়ে বড় প্রবাল দ্বীপ। এর আশেপাশেই সবচেয়ে বেশী দেখা যায়। বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন। অনিন্দ্য সুন্দর এবং ছােট এই প্রবাল দ্বীপ সব ধরণের বিষাক্ত প্রাণী থেকে মুক্ত। অতঃএব আমরা নির্ভয়ে থাকতে পারি। একদম শুরুতে যে দু’টি ঘটনা কল্পনা করতেবলেছি এগুলাে শুধুমাত্র কল্পনাই।
যদি শরীরের আক্রান্ত স্থানে কোনাে কাঁটা লক্ষ্য করা যায় তবে সাবধানে তা বের করে ফেলতে হবে। যদি হাসপাতালে নিতে দেরি হয় বা চিকিৎসা পেতে দেরি হয় তবে বিষ নিষ্ক্রিয় করার জন্য গরম পানি ব্যবহার করবে। আক্রান্ত স্থান গরম পানিতে ভিজিয়ে রাখবে। আক্রান্ত ব্যক্তির মুখে কোনাে খাবার দিবে না এবং ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোনাে ঔষধ দেবে না। দ্রুত চিকিৎসা পেলে এবং বিষ নিষ্ক্রিয় করা গেলে ভয়ের কারণ নেই।
আরো পড়ুনঃ
মঙ্গল গ্রহ এবং আরব আমিরাতের শহর নির্মাণের পরিকল্পনা
বাংলাদেশ বা এশিয়ার মানুষ হিসেবে আমাদের ভয় না পাওয়ার কারণ আমাদের এদিকে এই মাছের দেখা মিলে না। সাধারণত অস্ট্রেলিয়ায় এদের দেখতে পাওয়া যায়। গ্রেট ব্যারিয়ার রীফ, সবচেয়ে বড় প্রবাল দ্বীপ। এর আশে পাশেই সবচেয়ে বেশী দেখা যায়। বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন। অনিন্দ্য সুন্দর এবং ছােট এই প্রবাল দ্বীপ সব ধরণের বিষাক্ত প্রাণী থেকে মুক্ত। অতঃএব আমরা নির্ভয়ে থাকতে পারি।
একদম শুরুতে যে দুটি ঘটনা কল্পনা করতে বলেছি এগুলাে নিছকই কল্পনা। ক্যামােফ্লেজ বা ছদ্মবেশ ধারণ করাতে ওস্তাদ বলা চলে স্টোন ফিশকে। এদের ত্বকের লাল হলুদসহ নানান রঙ এমনভাবে মিশে থাকে যে তাদের প্রবাল প্রাচীর থেকে আলাদা করা যায় না। এছাড়াও অমসৃণ ত্বক তাদের এই ছদ্মবেশকে আরও শক্তিশালী করে। এরা অগভীর পানিতে নিশ্চলভাবে বসে থাকে যাতে তাদেরকে পাথর বলে ভুল হয়। এরা খুব দ্রুত শিকার করতে পারে।
নিশ্চলভাবে বসে থেকে শিকারের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। যখন শিকার তার আওতায় চলে আসে তখন সে দ্রুত আক্রমণ করে এবং গিলে ফেলে। শিকার করতে সাধারণত সময় নেয় ০.০১৫ সেকেন্ড । নিরীহ শিকাররা বুঝতেই পারে না কী থেকে কী হয়ে গেল! ছােট চিংড়ি, ছােট মাছ এগুলােই স্টোন ফিশের প্রিয় খাবার। শুধু শিকার ধরার জন্যই এরা দ্রুত আক্রমণ করে। কিন্তু সাধারণত এরা খুব ধীরে চলাফেরা করে।
স্টোন ফিশের অনন্য ক্ষমতা হলাে এরা পানি ছাড়াও অনেকক্ষণ বাঁচতে পারে। সেই অনেকক্ষণ কমপক্ষে ২৪ ঘন্টা। এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে, কেউ কেউ সমুদ্র থাকা স্টোন ফিশকে সুন্দর প্রবাল মনে করে হাতে নিয়েছে আর দংশনের শিকার হয়েছে।
স্টোন ফিশ বিষাক্ত হলেও এরা বড় বড় শিকারী প্রাণিদের প্রিয় খাদ্য। প্রধানত হাঙ্গর, রে, ইলেকট্রিক ফিশ এদের খুব পছন্দ করে খায়। স্টোন ফিশ মিলিয়ন মিলিয়ন ডিম দেয়। সেগুলাে থেকে মিলিয়ন মিলিয়ন বাচ্চাও হয়। কিন্তু পরিণত স্টোন ফিশে পরিণত হতে পারে খুব কম সংখ্যক স্টোন ফিশ। এর আগেই বেশীরভাগ স্টোন ফিশ অন্যদের মজাদার খাবারে পরিণত হয়। পরিণত হতে একেকটি স্টোন ফিশের সময় লাগে তিন বছর।
এরা সাধারণত আট থেকে দশ বছর বাঁচে। স্টোন ফিশ দলবদ্ধভাবে অথবা একাকী উভয়ভাবেই বসবাস করে। আজ তবে এতটুকুতেই থাক সমুদ্রের সবচেয়ে বিষাক্ত মাছের গল্প।
This is a Bengali article. This article is about Stone Fish, a poisonous sea creature.
Necessary references are hyperlinked inside the article.
Featured Image: Random Image