তবে আজকে আমরা এমন একটি যুদ্ধের গল্প শুনবো যা শেষ হয়েছিল মাত্র ৩৮ মিনিটে। ‘গিনিস বুক অফ রেকর্ডস’ অনুযায়ী এটি বিশ্বের ইতিহাসের সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম যুদ্ধ। তবে ক্ষুদ্রতম যুদ্ধ বলে এ যুদ্ধের গুরুত্ব কিন্তু মোটেও কম ছিল না। কারণ এই যুদ্ধে পরাজয়ের মধ্য দিয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র পরাধীন হয়ে যায়। যে পরাধীনতা থেকে স্বাধীনতা আনতে পরবর্তী কয়েক দশক ধরে সংগ্রাম করতে হয়েছে, রক্ত ঝরাতে হয়েছে। তাই মাত্র ৩৮ মিনিটে শেষ হলেও ওই যুদ্ধের প্রভাব এবং প্রেক্ষাপট ছিল অনেক বিস্তৃত এবং গুরুত্বপূর্ণ।
বলছিলাম অ্যাংলো-জাঞ্জিবার যুদ্ধের কথা। এত কম সময়ে শেষ হয়েছিল বলে অনেক ইতিহাসবিদ আবার ভ্রু কুঁচকান। তাদের ভাষ্যমতে, এত কম সময়ে সমাপ্ত হলে তাকে আবার যুদ্ধ বলা যায় নাকি! যা-ই হোক না কেন, সবকিছু ছাপিয়ে এটি ছিল একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। অ্যাংগো-জাঞ্জিবার যুদ্ধ ইতিহাসের পাতায় ঠায় নিয়েছে সর্বকালের ক্ষুদ্রতম যুদ্ধ হিসেবে। আসুন জেনে নেয়া যাক ঐতিহাসিক ৩৮ মিনিটের এই যুদ্ধ সম্পর্কে।
২৫ আগস্ট, ১৮৯৬ সালে সুলতান হামিদ বিন তোয়াইনি মৃত্যুর পর তাদের পরিকল্পনা পুরোপুরি ভেস্তে যায়। তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে গিয়ে সিংহাসনে বসেন খালিদ বিন বারঘাস। খালিদ বিন বারঘাস ছিলেন কট্টর ব্রিটিশবিরোধী এবং যেকোনো মূল্যে জাঞ্জিবারের স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখার পক্ষে। এর আগে ১৮৮৬ সালে জাঞ্জিবারের সুলতান ব্রিটিশদের সাথে একটি চুক্তি করে। চুক্তির শর্ত ছিল সুলতানের মৃত্যুর পর নতুন কেউ সিংহাসনে বসতে হলে ব্রিটিশ কাউন্সিলের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে। কিন্তু ব্রিটিশদের কাছ থেকে অনুমতি না নিয়েই সিংহাসনে বসেন খালিদ বিন বারঘাস। ব্রিটিশরা এটা কোনোভাবেই মেনে নেয়নি।
যুদ্ধের প্রেক্ষাপট
কিন্তু স্বাধীনতাকামী জাঞ্জিবারের সুলতান তা বেশিদিন মেনে নেয়নি। ১৮৫৮ সালে সুলতান মাজিদ বিন সাঈদ এই দ্বীপকে ওমান থেকে স্বাধীন দাবি করেন। তখন অবশ্য ব্রিটিশরা মাজিদকে সমর্থন জানায়। মাজিদের পরের সুলতানরা জাঞ্জিবারকে গড়ে তোলেন স্বাধীন আধুনিক শহর হিসেবে। সমুদ্রের পাড়ে গড়ে তোলেন বিশাল এক রাজপ্রাসাদ। আর তলে তলে ব্রিটিশরা ব্যবসায়ের নাম করে সমগ্র জাঞ্জিবার জুড়ে নিজেদের অধিপত্য বিস্তার করতে থাকে।
সমুদ্রের পাড়ে বিশাল রাজপ্রাসাদ গড়ে তুললেও সেই রাজপ্রাসাদে কোন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাই ছিল না। ধারণা করা হয় ব্রিটিশদের পরামর্শে নির্মিত প্রাসাদের দুর্বলতা তাদেরই ষড়যন্ত্রের একটা অংশ ছিল। এসময় জাঞ্জিবার সুলতানের সাথে ব্রিটিশরা তাল মিলিয়ে চলছিলেন এবং তাদের মধ্যে ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
১৮৮৬ সালের পর থেকে জাঞ্জিবার সরকারের ওপর ব্রিটিশরা প্রকাশ্যে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে। ১৮৯০ সালে খলিফা মৃত্যুবরণ করলে আলী বিন সাঈদ সিংহাসনে বসেন। তিনি ঐ অঞ্চলে ব্রিটিশদের মদদে বিস্তৃতভাবে ছড়িয়ে পড়া দাস প্রথা বন্ধ করে দেন। সুলতান আলী বিন সাঈদ জাঞ্জিবারকে ব্রিটিশদের উপনিবেশ হিসেবে ঘোষণা করেন। সেসময় ঐ অঞ্চলে ব্রিটিশদের বিগ্রেডিয়ার জেনারেল ছিলেন লয়েড ম্যাথিউস। সুলতান ম্যাথিউসকে তার মন্ত্রিপরিষদের প্রথম সারির মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন। ব্রিটিশরাও এই সুযোগে চুক্তিটা করে নেয়। চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়, ভবিষ্যতে কেউ সুলতান হতে গেলেই ব্রিটিশদের অনুমতি লাগবে। আর এই চুক্তি করার ফলে বিপাকে পড়েন পরবর্তী সুলতানরা।
আরো পড়ুনঃ
দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ হওয়ার কারণ এবং যার ফলশ্রুতি এর ভয়াবহ পরিণতি
ইসরায়েলি ষড়যন্ত্রের হাজার বছরের ইতিহাস
বিদ্রোহী এই লোকদের দমন করার জন্য সুলতান এক হাজার সদস্যের একটি সশস্ত্র বাহিনী গঠন করেন। আর এই বাহিনী গঠনের পরামর্শ দিয়েছিল ব্রিটিশরাই। কিন্তু কিছুদিন পর চিত্র পাল্টে যেতে লাগলো। এই বাহিনীর সদস্যরাই বিভিন্ন ইস্যুতে ব্রিটিশ সৈন্যদের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। প্রায়ই ছোটখাট বিষয় নিয়ে ব্রিটিশ সৈন্যদের সাথে এই বাহিনীর বিরোধ লেগেই থাকত। এজন্য ব্রিটিশদের কাছ থেকে এই বাহিনীর বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ আসতে থাকে সুলতানের কাছে।
এদিকে ব্রিটিশদের সাথে জার্মানদের বেশ বৈরিতা চলছিল সেই সময়। জার্মানরা সুলতানের ভাতিজা খালিদ বিন বারঘাসের সাথে পরামর্শ করে। জার্মানরা ১৮৯৬ সুলতানের মৃত্যুর পর খালিদ বিন বারঘাসকে ক্ষমতায় বসতে সহায়তা করে। কিন্তু ব্রিটিশরা এটা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনি। প্রথমত, তাদের অনুমতি ছাড়া কেউ সুলতান হতে পারবে না দ্বিতীয়ত, তারা চেয়েছিল সুলতানের মৃত্যুর পর হামাদ বিন মুহাম্মদকে সিংহাসনে বসাবে।
খালিদ ব্রিটিশদের হুমকি উপেক্ষা করে তার সৈন্যদেরকে ক্যাপ্টেন সালেহর তত্বাবধানে দেন। ক্যাপ্টেন সালেহকে নির্দেশ দেন রাজপ্রাসাদের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য। খালিদ মাত্র একদিনের মধ্যে স্থানীয় লোকদের ধরে সৈন্যবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করেন। অবশেষে তারা ২,৮০০ সদস্যের একটি বাহিনী তৈরি করেন।
কিছু আর্টিলারি, মেশিনগান, গ্যাটলিং গান ও একটি ব্রোঞ্জ ক্যাননের মাধ্যমে গড়ে তোলেন সশস্ত্র বাহিনী। এছাড়া ‘এইচএইচএস গ্ল্যাসগো’ নামের একটি রাজকীয় যুদ্ধ জাহাজ দিয়ে কিছু সৈন্যদের মাধ্যমে নৌবাহিনীও গঠন করেন। এই ‘এইচএইচএস গ্ল্যাসগো’ একসময় ব্রিটিশ রানী জাঞ্জিবারের সুলতানকে উপহার দিয়েছিলেন।
শুরু হল যুদ্ধ
সুলতান খালিদ তার অবস্থানে অনড় রইলেন। নিজের দেশ এবং জন্মভূমিকে স্বাধীন রাখার জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিলেন। যদিও ওই যুদ্ধে জাঞ্জিবারের পরাজয় ছিল নিশ্চিত। কারণ ব্রিটিশদের আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের সামনে তার অপ্রশিক্ষিত সৈন্যরা কিছুই না। তবুও তিনি দমে গেলেন না।
২৬ আগস্ট হার্বার থেকে সকল প্রকার বাণিজ্যিক জাহাজ সরিয়ে নেওয়া হয়। ব্রিটিশ নারী ও শিশুদেরকেও নিরাপদ জায়গায় নেওয়া হয়। সেদিন রাত্রে ছিল থমথমে। অন্যান্য দিন শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে বাদ্যযন্ত্রের শব্দ শোনা যেত। কিন্তু সেদিন ছিল সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ। কারণ পরদিন সকাল ৯টায় সময় শেষ হচ্ছে।
অবশেষে ৯:০২ মিনিটে ব্রিটিশরা রাজপ্রাসাদকে লক্ষ্য করে গোলা ছোড়ে। শুরু হয় যুদ্ধ। অপরদিকে সুলতান বাহিনীর পক্ষ থেকেও গুলি ছোড়া শুরু হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই আগুন ধরে যায় রাজপ্রাসাদে। সুলতান খালিদের বাহিনী কিছু কামান, আর্টিলারি নিয়ে রাজপ্রাসাদের সামনে অবস্থান করে।
যুদ্ধ শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যেই ব্রিটিশরা সুলতানের বিখ্যাত ‘এইচএইচএস গ্ল্যাসগো’ যুদ্ধজাহাজ ডুবিয়ে দেয়। সুলতানের অপ্রশিক্ষিত এবং অদক্ষ সৈন্যরা এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে থাকে। অন্যদিকে ব্রিটিশ সৈন্যরা ক্ষিপ্রতার সাথে আক্রমণ পরিচালনা করতে থাকে। তাছাড়া কৌশলগতভাবেও ব্রিটিশরা ভালো অবস্থানে ছিল। ব্রিটিশ সৈন্যদের আক্রমণের কয়েক মিনিটের মধ্যেই সুলতানের সৈন্যরা যুদ্ধের মাঠ ছেড়ে পালাতে থাকে।
ব্রিটিশ সৈন্যরা সর্বপ্রথম গুলি করেছিল ৯:০২ মিনিটে। এ সময়টাকে যুদ্ধের শুরু হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এবং ব্রিটিশ সৈন্যরা রাজপ্রাসাদে ঢুকে পতাকা পুড়িয়ে দেয় ৯:৪০ মিনিটে। সে সময়টা যুদ্ধের শেষ সময় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাই হিসাব মতে যুদ্ধে ব্যয়িত মোট সময় ৩৮ মিনিট। পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত যুদ্ধ হিসেবে এটি গিনেস বুক অব রেকর্ডসে নাম লিখিয়েছে। অনেকেই এই যুদ্ধকে ব্যঙ্গ করে “দ্য ব্রেকফাস্ট ওয়ার” নাম দিয়েছেন।
Reference:
This is a Bengali article. It’s About the Anglo-Zanzibar War of 1896 is history’s shortest war.
Featured Image: Eskify